Header Ads

মানুষের সেতু



আরাফাত যখন বাসায় এলো তখন বাসা একদম খালি। আব্বা-আম্মা চলে গেছেন খালাম্মার বাসায়। আপাও কাল থেকে হোষ্টেলে। সে বাসায় ঢুকলো পাশের বাসা থেকে চাবি নিয়ে। শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিয়েই চোখ বুঁজে ফেললো। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুলের ঘটনাটা। শাহেদের সাহসতো কম নয়। তাকে সবার সামনেই অপমান করলো সে। গতবারের এস,এস,সির রেজাল্ট তার খারাপ হয়েছে বলেই যে, সে নতুন এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে; এই কথাটা শাহেদের এভাবে না বললেও চলতো। দীর্ঘদিনের এই বন্ধু আজ রাগারাগির এক পর্যায়ে তাকে একদম ডুবিয়ে দিলো। নতুন বন্ধুদের সামনে মুখে চুনকালি লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাটি ঘটালো শাহেদ।
আরাফাত ঘুমাতে না পেরে বারান্দায় এসে বসলো। প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে তার। বিকাল এখনো শুরু হয়নি। রোদের তাপটা আছে। চারতলার বারান্দা থেকেই শোনা যাচ্ছে, পাশের গলি মুখর করে তোলা গাড়ী আর রিকসার ব্যস্ত চলাচলের একঘেঁয়ে শব্দ। আরাফাতের কিছুই ভালো লাগছে না। ভাত খেতেও ইচ্ছা হয়নি। বিকালে মোড়ের পাশে কলোনীর মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাওয়াটাও আজ আর হবে না। বার বার অপমানের বোধ তাকে বিষণœ করে দিচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, শাহেদের সাথে আর কোন সম্পর্ক নেই। কথাই বলবে না সে শাহেদের সাথে। তার কাছে যে গল্পের বইগুলো রয়েছে শাহেদের, কালই  স্কুলে গিয়ে মনিরের মধ্যস্থতায় ফেরত দিয়ে দিবে।
আরাফাত আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। অল্প কিছুক্ষণ পরই আসরের আযান দিলো মহল্লার মসজিদে। সঙ্গে সঙ্গেই কলিং বেলেরও শব্দ হলো। সম্ভবত আব্বা-আম্মা এসেছেন,  আরাফাত ভাবলো। কিন্তু দরজা খুলেই আরাফাত দেখলো, মনির দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাত সরে দাঁড়াতেই মনির ভেতরে চলে এলো।
মনির! তুই এসে ভালোই করেছিস্। আমার কাছে শাহেদের কিছু বই আছে। ওগুলো তুই ওকে পৌঁছে দিবি। ঐ হিংসুক শয়তানটার সাথে আমি আর কথা বলছি না।
আরাফাত কথাগুলো একদমে বলেই শেল্ফে রাখা দশ-বারটা বই ঝটপট হাতে উঠিয়ে নিলো। তারপর সোফায় বসেথাকা মনিরের হাতে বইগুলো তুলে দিলো। মনির চুপচাপই ছিলো এতক্ষণ। আরাফাতের মনের অবস্থাটা সে আন্দাজ করতে পারছে পুরোপুরিই। পাকিস্তানী ক্রিকেটার সাঈদ আনোয়ারের একটি ব্যাটিং-স্কোর নিয়ে তর্ক আর ঝগড়ার এক পর্যায়ে শাহেদের এই কান্ডটা একদম ভালো লাগেনি মনিরেরও। এবার সে মুখ খুললো: ঠিক আছে। বই পৌঁছানো দরকার, পৌঁছে দেবো। কিন্তু অস্থির হওয়ার কী আছে। শাহেদ তো আসলে তোর বন্ধু, আজ একটি ভুল সে করেছে তোকে কষ্ট দিয়ে। সে ভালো ছাত্র বলেই তোকে অপমান করাটা তার ঠিক হয়নি। কিন্তু তাই বলে কি শাহেদের  সাথে এখনই সব চুকিয়ে বুকিয়ে দিতে হবে ?
: হ্যাঁ। ওই হিংসুক ভালো ছাত্রের সাথে আমি আর কথাই বলছিনা। ওর তো মনটাই ছোট।
: শোন্ আরাফাত! তুই আসলে কষ্ট পেয়ে গেছিস্ বলে তোর মনের অবস্থাটা এখন অনেক খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু শাহেদও যে তোর খুবই ভালো একজন বন্ধু, এটা কিন্তু তুই অস্বীকার করতে পারবি না। গত মাসে পত্রিকায় যখন তোর গল্প ছাপা হলো, শাহেদই সেটা গোটা ক্লাস জুড়ে সবাইকে দেখিয়েছে। স্যারদের রুমে রেখে এসেছে পত্রিকার কপি। তোর ব্যাপারে মহল্লার কেউ কোন বাজে মন্তব্য করতে চাইলে শাহেদকে দেখেছি ক্ষেপে যেতে। আজকের ব্যাপারটাই শুধু ভিন্ন। এটা ভুলে যা।
: দরকার নেই। আমি শাহেদের সাথে কথাই বলছিনা। তুই আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করবি না।
: ঠিক আছে বুঝানোর চেষ্টা করব না। শাহেদ যে আমার হাত ধরে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে, সেটা তো বলে যাওয়া দরকার। বলে গেলাম। শাহেদ বলেছে আরাফাতকে বলবি- আমি লজ্জিত। তুই যদি মাঠে খেলতে যাস্ তাহলে শাহেদের সাথে দেখা হবে। শাহেদের তার আব্বার সঙ্গে চিটাগাং যাওয়ার কথা ছিলো। সে যায়নি শুধু তোর সাথে কথা বলার জন্যই। এখন তোর ইচ্ছা।
মনির কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। আরাফাত চুপ করে বসে রইলো কিছু না বলে। এরপর মনির যখন চলে যেতে চাইলো, আরাফাত বললো : দাঁড়া! আমি ভাত খেয়ে নিই। তারপর চল্ ওজু করে আসরের নামাযটা পড়ে ফেলি। তুই ভাত খেয়েছিস ?
আরাফাতের বিষন্নতা ও ক্ষোভমুক্ত ঝরঝরা কথায় মনির খুশি হয়ে বললো : হ্যাঁ, আমি ভাত খেয়েছি। স্কুল থেকে ফিরেই ভাত খেয়ে শাহেদের বাসায় গিয়েছিলাম। তুই খা, আমি বাথরুমে যাচ্ছি ওজু করতে।’
আসরের নামায শেষ করে তারা বাসা থেকে বের হতে যাবে, তখনই কলিং বেলের শব্দ হলো আবার। আরাফাত দরজা খুলে দেখলো, তার আব্বা-আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে। তাদের পেছনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে শাহেদ। আরাফাত কিছুই বুঝলো না। মনিরও কিছুটা অবাক হলো। শাহেদের তো এখানে আসার কথা নয়। আরাফাতের আম্মা শাহেদকে ভেতরে এসে বসতে বললেন। শাহেদ বললো: না, খালাম্মা! বসবো না আব্বার সাঙ্গে সন্ধ্যার পর আমাকে চিটাগাং রওয়ানা দিতে হবে। এজন্যই একটু এসেছিলাম।...
: ঠিক আছে, যাও। বসে আলাপ করো তোমরা বন্ধুরা! আমি একটু তোমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি।’ আরাফাতের আম্মা বললেন।
শাহেদ বললো: খালাম্মা! আসলে আমি স্কুলে আজ আরাফাতকে একটা কথা বলে একটু কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে এসেছি। এভাবে কথা বলে ওকে কষ্ট দেওয়া আমার উচিত হয়নি। আমার চোখ খুলে দিয়েছে মনির।
খালাম্মা কিছুটা অবাক হওয়া চোখে তিন বন্ধুর দিকে তাকালেন। তারপর হাসি মুখে বললেন: তোমাদের মধ্যে আবার ঝগড়া-ঝাটি হয় নাকি ? খালাম্মার কথায় তিনজনই হেসে ফেললো। শাহেদ বললোঃ খালাম্মা! ঝগড়া নয়, সমস্যাটা আসলে আমারই তৈরী। এ সমস্যাটার কারণে আমার আর আরাফাতের মাঝে হয়তো স্থায়ী ঝগড়াই হয়ে যেতো। কিন্তু মনির আমাকে বুঝিয়েছে। শাহেদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরাফাত কিছুটা মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো: আমাকেও তো বুঝাতে এসেছে মনির।
মনির হাসতে লাগলো। খালাম্মা তিন বন্ধুকে সোফায় বসতে বলে বললেন: শোনো তোমরা! মনির আজ তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাজটি করেছে। বন্ধুর জন্য তো বন্ধুর শুধু নয়, এই ভালো কাজটি করার যোগ্যতা সব মানুষেরই থাকলে ভালো হতো। মানুষের মাঝে সমঝোতা করিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে এখন উল্টো আমরা একজনকে আরেকজনের পিছনে লাগিয়ে দিই। খালাম্মার কথা মাথা নীচু করে শুনতে লাগলো তিন বন্ধু। মনির যেন লজ্জাই পেয়ে গেলো একটি ভালো কাজ করে, এমন একটি ভঙ্গি নিয়েই বসে আছে সে।
কিছুক্ষণ পর প্লেটে সাজিয়ে ছোট ছোট পিঠা আর চা নিয়ে এসে খালাম্মা বসলেন। তারপর বললেনঃ ‘তোমরা যদি বাইরে একটু হাঁটতে-বের হতে চাও, চা খেয়ে এখনই বের হয়ে পড়ো। মাগরিবের আযান হতে বেশি বাকি নেই।’ কথা শেষ করে খালাম্মা মনিরের হাতে একটি পিঠা তুলে দিয়ে আবার বললেন: আমাদের নবীজী সা. -এর একটি হাদীস তোমরা শুনবে?
তিন বন্ধুই সম্মতি জানিয়ে মাথা কাত করলো। প্রতিটি কথাই ভালো লাগছে তাদের। খালাম্মাকে মনির ও শাহেদ আগেও খুব কমই রাগ করতে দেখেছে। হাসিমুখ একজন মানুষ তিনি। আজ যখন খালাম্মা বন্ধুদের,  মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো, খালাম্মা যেন তাদের সমান্তরাল একজন মানুষ। খালাম্মার কথাগুলো শোনার জন্য তাদের প্রতিটি কান তাই প্রস্তুত হয়েই আছে।
আরাফাতের আম্মা বললেন: নবীজী বলেছেন- আমি কি তোমাদেরকে নফল নামায-রোযার চেয়েও উত্তম একটি জিনিসের কথা বলবো না ? সেটা হচ্ছে পরস্পরের মাঝে সমঝোতা ও সুসম্পর্ক তৈরী করে দেয়া। আর তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে। কারণ হিংসা-বিদ্বেষ (পূণ্যকে) চেঁছে শূন্য করে দেয়।
খালাম্মার কথায় যেন একটি সুন্দর দিগন্ত খুলে গেল তিন বন্ধুর সামনে। আরাফাত, শাহেদ আর মনির উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই যেন ওরা অনেক পরিণত হয়ে উঠলো। মনির বললোঃ খালাম্মা! আমাদের জন্য আপনি দু’আ করবেন।
আরাফাতের আম্মা মনিরের কথায় কোন উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখে শুধু আশ্বাস ও আদরের স্মিত একটি হাসি ফুটে উঠলো। 

No comments

Powered by Blogger.